শনিবার, ১৯ আগস্ট, ২০১৭

Sarbamangla and Gopinath Temple, Muragachha, Nadia,West Bengal


সর্বমঙ্গলা  ও  গোপীনাথ  মন্দির,  মুড়াগাছা,  নদিয়া

শ্যামল  কুমার  ঘোষ 

            শিয়ালদহ-লালগোলা  রেলপথে  মুড়াগাছা  একটি  স্টেশন।  শিয়ালদহ  থেকে  দূরত্ব  ১১৭  কিমি।  স্টেশন  থেকে  ১.৫  কিমি পশ্চিমে  মুড়াগাছা  গ্রাম।  গ্রামটি  নাকাশিপাড়া  থানার  অন্তর্গত।  গ্রামের  পাশ  দিয়ে   গুড়গুড়িয়া  নদী  প্রবাহিত।  যদিও  বর্তমানে  তা  কোথাও  কোথাও  অবরুদ্ধ। 
 
            বর্তমান  মুড়াগাছা  গ্রামের  পূর্বনাম  ছিল  রাঘবপুর।  আনুমানিক  ১১০০  বঙ্গাব্দে  রাঘবরাম  দেব  বিশ্বাস  এই  এলাকায়  তহশিলদার  রূপে  বসতি  স্থাপন  করেন  এবং  পরে  তাঁর  নামানুসারে  জনপদের  নাম  হয়  রাঘবপুর।  রাঘব  বিশ্বাস  ব্রাহ্মণদের  ভূমি  ইত্যাদি  দান  করে  বসতি  স্থাপন  করান।  তখন  এই  অঞ্চল  যশোহর  জেলার  দিগম্বরপুরের  জমিদারের  জমিদারির  অন্তর্ভুক্ত  ছিল।  রাঘবরাম  বিশ্বাস  ওই  জমিদারের  তহশিলদার  ছিলেন।  

            গ্রামের  নাম  পরিবর্তন  সম্পর্কে  কিংবদন্তি,  প্রাচীন  রাঘবপুর  গ্রামে  একবার  বড়  রকমের  অগ্নিকাণ্ড  হয়  এবং  তার  ফলে  বাড়িঘর  ও  গাছপালা  পুড়ে  মুড়া  বা  মুড়ো  হয়ে  যায়।  সেই  সময়  একদিন  কৃষ্ণনগরের  মহারাজা  কৃষ্ণচন্দ্র  গোপাল  ভাঁড়কে  সঙ্গে  নিয়ে  গুড়গুড়িয়া  নদী  পথে  বহিরগাছি   গ্রামে  তাঁর  গুরুগৃহে  যাচ্ছিলেন।  মুড়াগাছার  কাছ  দিয়ে  যাওয়ার  সময়  মহারাজ  অগ্নিদগ্ধ  গ্রাম  দেখে  গোপাল  ভাঁড়কে  গ্রামের  নাম  জিজ্ঞাসা  করায়  গোপাল  ভাঁড়  পোড়া  গাছগুলোর  দিকে  তাকিয়ে  রসিকতা  করে  বলেন, " মহারাজ,  গ্রামের  নাম  মুড়োগাছা।"  তখন  থেকে  এই  গ্রাম  মুড়োগাছা  বা  মুড়াগাছা  নামে  পরিচিত  হয়।  যদিও  এব্যাপারে  কোন  লিখিত  তথ্য  নেই।  
         
             হিজলির  নিমক-মহলের  দেওয়ান  কাশীপ্রসাদ  মুখোপাধ্যায়   এবং  তাঁর  বংশের   দেবীদাস  মুখোপাধ্যায়  এখানে  মন্দির-বিগ্রহাদি  প্রতিষ্ঠা  করেন।  স্থানীয়  বাজারে  সর্বমঙ্গলার  একটি  দালান  মন্দির  ও  তিনটি  আটচালা  শিবের  মন্দির  সংযুক্তভাবে  নির্মিত।  উঁচু  ভিত্তিবেদীর  উপর  স্থাপিত,  পশ্চিমমুখী  মন্দিরগুলির  সামনে  অলিন্দ  আছে।  একটি  কক্ষে  মৃন্ময়ী  ও  দ্বিভূজা  দেবী সর্বমঙ্গলা  প্রতিষ্ঠিতা  ও  চণ্ডীধ্যানে  নিত্যপূজিতা।  তিনটি  শিবমন্দিরে  তিনটি  কষ্টিপাথরের  শিবলিঙ্গ  প্রতিষ্ঠিত  ও   নিত্যপূজিত।  মন্দিরগুলি  দেবীদাস  মুখোপাধ্যায়  কর্তৃক  ১১৯৭ বঙ্গাব্দে ( ১৭৯০ খ্রীস্টাব্দে )  প্রতিষ্ঠিত।  তবে  এই  প্রতিষ্ঠা-সাল  নিয়ে  মতভেদ  আছে।  ১৪০৮  বঙ্গাব্দে  কিছু  মানুষের  চেষ্টা  ও  অর্থানুকূল্যে  মন্দিরটির  সংস্কার  করা  হয়েছে।  আগে  সামনের  দেওয়ালগুলিতে  পঙ্খের   অলংকরণ  ছিল  এখন  একটি  মাত্র  শিবমন্দিরে  সামান্যই  অবশিষ্ট  আছে।  আগে  কাছেই  একটি  বটগাছের  নিচে,  পাথরের  প্রাচীন  সর্বমঙ্গলা  মূর্তি  স্থাপিত  ছিল।  সেটি  এখন  একটি  মন্দির  নির্মাণ  করে  সেই  মন্দিরে  প্রতিষ্ঠা  করা  হয়েছে। 

            সর্বমঙ্গলাদেবীর  মন্দির  প্রতিষ্ঠা  ও  তাঁর  পূজা  প্রচলন  সম্পর্কে  শোনা  যায়  যে  স্বর্গীয়  দেবীদাস  মুখোপাধ্যায়  স্বপ্নাদেশে  জানতে  পারেন  যে  গুড়গুড়িয়া  নদীর  নাপিতঘাটের  কাছে  সর্বমঙ্গলাদেবীর  প্রতীক  স্বরূপ  একটি  শিলাখণ্ড  রক্ষিত  আছে।  তিনি  যেন  ওই  শিলাখণ্ডটির  পূজার  ব্যবস্থা  করেন।  এই  স্বপ্নাদেশ  পেয়ে  দেবীদাস  বাবু  নাপিতঘাট  থেকে  শিলাখণ্ডটি  নিয়ে  এসে  বাজারের  নিকট  একটি  বটতলায়  স্থাপন  করেন।  পরে  ১১৯৭  বঙ্গাব্দের  বৈশাখ  মাসের  সংক্রান্তি  তিথিতে  একটি  পাকা  মন্দির  প্রতিষ্ঠা  করে  শিলাখণ্ডটিসহ  একটি  মৃন্ময়ী  চণ্ডী  মূর্তি  প্রতিষ্ঠা  করেন।  সেই  থেকে  দেবীর  নিত্যপূজা  ও  বৈশাখ  মাসের  সংক্রান্তিতে  তিন  দিন  ব্যাপী  বার্ষিক  অভিষেক  উৎসব  পালন  করা  হয়।  আগে  মন্দিরের  সামনে  চাঁদনি  আকৃতির  একটি  নাটমন্দির  ছিল।  এখন  শুধু  তার  স্তম্ভগুলো  দাঁড়িয়ে  আছে।  

            পূর্বে,  উৎসবের  প্রথম  দিনের  প্রথম  নৈবেদ্য  স্বর্গীয়  দেবীদাস  বাবুর  সেজ  মেয়ে  সাধনপাড়া  নিবাসিনী  অন্নপূর্ণা  দেবীর  বাড়ি  থেকে  আসত।  পরে  দেবদাস  বাবু  ও  রাঘবরাম  বাবুর  বাড়ি  থেকে  নৈবেদ্য  আসতো।  পূজার  দ্বিতীয়  দিনে  ধর্মদহ  নিবাসী  সুরেন্দ্রচন্দ্র  মুখোপাধ্যায়ের  বাড়ি  থেকে  পূজা  আসত।  পরে  মুড়াগাছা  গ্রামের  বিভিন্ন  পাড়া  থেকে  পুজো  আসত।  তৃতীয়  দিনে  অন্যান্য  গ্রাম  থেকে  পুজো  আসত।  এই  পূজার  নৈবেদ্য  নিয়ে  আসার  দৃশ্য  দেখার  মত।  পূজার  নৈবেদ্য  প্রথমে   কাঠের  বারকোষ,  পিতলের  খালা  বা  বাঁশের  তৈরী  ডালায়  সাজানো  হয়।  পরে  সেগুলি  পাড়া  বা  গ্রামের  বালক-বালিকা,  স্ত্রীলোক-পুরুষ  সকলে  সারিবদ্ধ  ভাবে  মাথায়  করে,  ঢাক  ইত্যাদি  বাজনা,  শাঁক-উলুধ্বনি  সহযোগে,  সারা  গ্রাম  প্রদক্ষিণ  করে  মন্দিরে  নিয়ে  আসেন।  পূর্বে  ব্যাগপাই  বাজনা  ও  রায়বেশে  নাচের  আয়োজন  থাকত।  এখানে  উল্লেখ্য,  এই  উৎসবটি  ব্যক্তি-বিশেষের  হলেও  এই  গ্রাম  ও  আশে-পাশের  গ্রামের  সর্বসাধারণ  এই  উৎসবে  যোগদান  করতেন  এবং  এখনও  করেন।  এমনকি,  সেই  সময়ে  নিম্নশ্রেণীর  হিন্দুরাও  এই  উৎসবে  সক্রিয়  অংশ  গ্রহণ  করতেন।  এই  উপলক্ষে  মন্দির  প্রাঙ্গণে  এক  মেলা  বসে।  স্থানীয়  লোকেরা  একে  যাতের  মেলা  বলে।  মেলায়  বিক্রেতারা  তাঁদের  বিক্রয়-সামগ্রী  নিয়ে  হাজির  হন।  আগে  মেলাটি  একমাস ধরে  চলতো  ও  মেলা  উপলক্ষে  যাত্রা,  সার্কাস,  পুতুল  নাচ,  ম্যাজিক  প্রদর্শন,  তরজা  ইত্যাদির  আসার  বসত।  তবে  প্রধান  আকর্ষণ  ছিল  যাত্রা।  তার  জন্য  উৎসবের  কয়েক  মাস  আগে  থেকে  প্রস্তুতি  চলত।  এখন  সব  গ্রামীণ  মেলার  মত  এ  মেলারও  জৌলুস  হারিয়েছে।
  
সর্বমঙ্গলা  ও  শিব  মন্দির ( বাঁ  দিক  থেকে  তোলা ) 

সর্বমঙ্গলা  ও  শিব  মন্দির ( ডান  দিক  থেকে  তোলা )

তিনটি  শিবমন্দিরের  শিখর-দেশ 

পঙ্খের  কাজ 

চাঁদনির  মধ্যে  থেকে  তোলা  মন্দিরের  ছবি  

কষ্টিপাথরের  একটি  শিবলিঙ্গ 

শিবমন্দিরের  সামনের  দেওয়াল 

পাথরের  সর্বমঙ্গলা  মূর্তি 

মা  সর্বমঙ্গলা - ১

মা  সর্বমঙ্গলা - ২     

            কাশীপ্রসাদ  মুখোপাধ্যায়  পল্লীর  অন্যত্র,  বড়  দেওয়ান  বাড়িতে,  তিনটি  চারচালা  মন্দির  সংযুক্তভাবে  নির্মাণ  করেন। পশ্চিমমুখী  এই  দেবালয়ের  সামনে  ঢাকা  বারান্দা  আছে।  একটি  কাঠের  সিংহাসনে  গোপীনাথ  ও  রাধারাণী,  আর  একটি  কাঠের  সিংহাসনে  অষ্টধাতুর  অন্নপূর্ণা  ও  একটি  বেদির  উপর  শ্বেতপাথরের  শিবলিঙ্গ  প্রতিষ্ঠিত  ও  নিত্য  পূজিত। 



বড়  দেওয়ান  বাড়ির  ফটক 

গোপীনাথ  মন্দির 

শ্বেত  পাথরের  শিবলিঙ্গ 

অন্নপূর্ণা  বিগ্রহ 

গোপীনাথ  ও  রাধিকা  বিগ্রহ - ১

গোপীনাথ  ও  রাধিকা  বিগ্রহ - ২

            কাশীপ্রসাদ  মুখোপাধ্যায়  কর্তৃক  নির্মিত  দ্বাদশকোণ  ভিত্তিবেদির  উপরে  দ্বাদশকোণ  রাসমঞ্চটি  এখানকার  অন্যতম  দ্রষ্টব্য  পুরাকীর্তি।  এরকম  রাসমঞ্চ  নদিয়া  জেলাতে  আর  নেই।  আগে  মঞ্চের  উপরে  ওঠার  জন্য  একটি  কাঠের  সিঁড়ি  ছিল।  রাসমঞ্চটির  অবিলম্বে  সংস্কারের  প্রয়োজন।  এখানে  আগে  গোপীনাথের  রাস  উৎসব  অনুষ্ঠিত  হত।  এই  রাসতলায়  পল্লীর  গাজন  ও  চড়ক   উৎসব  পালন  করা  হত।  রথ  ও  চড়কে  ছোটখাট  মেলা  বসত।  কাশীপ্রসাদের  পিতলের  রথটি  বড়  দেওয়ান  বাড়ি  থেকে  রাসতলা  পর্যন্ত  টানা  হত।  সে  রথ  এখন  আর  নেই।  রাসমঞ্চের  পাশে  একটি  দালান  মন্দিরে  চারটি  শিবলিঙ্গ  প্রতিষ্ঠিত  ও  নিত্য  পূজিত।

            পরিশেষে  বলি,  মুড়াগাছার  ছানার  জিলাপি  বিখ্যাত।  তাই  গ্রাম  ছাড়ার  আগে  এর  স্বাদ  গ্রহণ  করতে  ভুলবেন  না।

            গ্রামটি  পরিদর্শনের  তারিখ :  ১৪.০৮.২০১৭
               

রাসমঞ্চ - ১

রাসমঞ্চ - ২

সহায়ক  গ্রন্থ :

           ১)  নদীয়া  জেলার  পুরাকীর্তি :  মোহিত  রায়  ( তথ্য-সংকলন  ও  গ্রন্থনা )
           ২)  পশ্চিম  বঙ্গের  পূজা-পার্বণ  ও  মেলা :  অশোক  মিত্র  সম্পাদিত   

           -------------------------------------------

            আমার  ইমেল :  shyamalfpb@gmail.com   প্রয়োজনে  যোগাযোগ  করতে  পারেন।

           --------------------------------------------

 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন